১২ জুন ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ
দুই বছর আগে সিটি বাসের কন্ডাক্টর জাহিদুল ইসলাম রনির (২৭) সঙ্গে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণীর বিয়ে হয়। শুরুতে দুজন সুখেই ছিলেন। কিন্তু একদিন তানিয়া (ছদ্মনাম) জানতে পারেন, তার স্বামী মাদকাসক্ত এবং তিনি নিয়মিত কাজেও যান না। বৈবাহিক জীবনে উত্থান-পতনের মধ্যেই রনি একদিন তানিয়াকে একটি চাকরির কথা বলেন। তিনি জানান, ভারতে প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকরির খোঁজ পেয়েছেন । চেষ্টা করছেন তানিয়াকে সেখানে কাজটি দেওয়ার। চাকরিটা হয়ে গেলে তানিয়ার ভাগ্য বদলে যাবে।
স্বামীকে বিশ্বাস করেন তানিয়া। তার স্বামী রনি রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় এক ‘ম্যাডাম’র কাছে তানিয়াকে নিয়ে যান। ওই ম্যাডাম চেন্নাইয়ের একটি বৃদ্ধাশ্রমে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তানিয়াকে ভারতে যাওয়ার কথা বলেন। চেন্নাই পৌঁছে তানিয়া জানতে পারেন, তার স্বামী তাকে যৌনকর্মী পাচারকারী চক্রের কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। ভাগ্যক্রমে, এই ঘটনার চার মাস পর ২০ বছর বয়সী তানিয়া চেন্নাই থেকে পালিয়ে দেশে ফেরেন।
সম্প্রতি ঢাকায় ফিরে মানব পাচার আইনে হাতিরঝিল থানায় তার স্বামীসহ নয় জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি। কয়েকদিন আগে ভারত থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা তিনজনের মধ্যে তিনিও একজন। মামলার বিবৃতিতে মানব পাচারের শিকার ও ভারতে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তানিয়া।
তিনি জানান, স্বামীর সঙ্গে ডেমরার কাজলাতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি রনি হাতিরঝিল এলাকার চেন্নাইয়ের বৃদ্ধাশ্রমের ‘লেডি অফিসার’ পরিচয়ে ‘নদী ম্যাডাম’ এর সঙ্গে তানিয়ার পরিচয় করিয়ে দেন। তাকে বলেন, নদী ম্যাডাম নার্স হিসেবে কাজ করার জন্য কয়েকজন নারী নিয়োগ দিচ্ছেন। নদী ম্যাডাম তানিয়াকে জানান, ৬ জানুয়ারি তিনি ভারতে যাবেন এবং তানিয়া যদি চাকরি করতে চায় তাহলে তাকে তার সঙ্গে যেতে হবে। ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তানিয়া, নদী ও আরেক নারী কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করেন। তৃতীয় নারীও ভারতে কাজ করার জন্য তাদের সঙ্গে রওনা দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে তারা সাতক্ষীরা সীমান্তের কাছে একটি বাড়িতে পৌঁছান। সেটা ছিল মানব পাচারের জন্য একটি ট্রানজিট পয়েন্ট।
সেখানে তানিয়া আরো পাঁচ-ছয় জন নারীকে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেন। রাত ১১টার দিকে, তাদের মধ্যে ছয়জন সীমান্ত পার হয়েছিলেন। সীমান্ত থেকে পশ্চিমবঙ্গের একটি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পালাক্রমে পাঁচজন তাদেরকে গাইড করেন। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাদেরকে ছয় ঘন্টা হাঁটতে হয়েছিল। ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পরে ক্যামেরা হাতে একজন ওই বাড়িতে আসেন। তিনি ভারতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করার জন্য তাদের ছবি তোলেন।
মামলার বিবৃতিতে তানিয়া বলেছেন, রাতের বেলা তাদেরকে চেন্নাইয়ের একটি ফ্লাইটের টিকেট ও আধার কার্ড দেওয়া হয়। পরদিন সকালে তানিয়াকে ফ্লাইটে করে চেন্নাই নিয়ে পাক্কাম এলাকার একটি বাড়িতে রাখা হয়। সেখানে তানিয়া আরও চার-পাঁচ জন নারীকে দেখতে পান। দুদিন পর, তানিয়াকে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিউটি ও আজহারুল নামে চক্রের দুই সদস্য তাদেরকে নজরে রাখেন। পরের দিন বিউটি ও আজহারুল আমাকে বলেন, একজন অতিথি আমার ঘরে আসবেন এবং তার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি তখন বুঝতে পারি যে, আমার সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে…। তানিয়া সে সময় নদীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা তাকে হেনস্তা করেন, উলঙ্গ করে ভিডিও করেন এবং তাদের কথামতো কাজ না করলে ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, তারা আমাকে বলেছিলেন, আমার স্বামী আমাকে নদীর কাছে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন এবং নদী আমাকে তাদের কাছে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সেখানে তানিয়া এক ক্লায়েন্টের কাছে সাহায্য চান। তিনি ছিলেন কলকাতার বাসিন্দা। তানিয়াকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেন তিনি।
গত ৩ মে তানিয়াকে ১০ দিনের জন্য পতিতাবৃত্তির কাজে একটি ম্যাসাজ পার্লারে পাঠানো হয়েছিল। প্রথম দিন তিনি জানালার কাঁচ ভেঙে সেখান থেকে পালিয়ে যান। চেন্নাই থেকে ট্রেনে কলকাতায় পৌঁছান। গত ১০ মে তিনি সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন।
এর আগে ৭ মে ভারতে পাচার হওয়া ১৮ বছর বয়সী আরেকজন বেঙ্গালুরু থেকে পালিয়ে দেশে আসেন। গত ১ জুন তিনি হাতিরঝিল থানায় রিফাদুল ইসলাম হৃদয় (২৬) ওরফে ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ ও ওই চক্রের ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
তানিয়ার চেন্নাইয়ে পাচারকারী দলের সঙ্গে হৃদয়ের চক্রের কোনও যোগসূত্র রয়েছে কি না পুলিশ তা তদন্ত করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (তেজগাঁও বিভাগ) হাফিজ আল ফারুক বলেন, ‘আমরা তার স্বামীকে খুঁজছি এবং এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছি।’