২২ জুন ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ
আন্তর্জাতিক নারীপাচারের অন্যতম হোতা নদী আক্তার ইতি ওরফে জয়া আক্তার জান্নাত ওরফে নূরজাহানসহ (২৮) চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিকে এ চক্রের অন্যতম সমন্বয়ক নদী আক্তার। সাধারণ এক নারীর পরিচয়ের আড়ালে রয়েছে তার ভয়ঙ্কর রূপ। ভালো চাকরিসহ নানা প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন দেশে নারী পাচার চক্রের অন্যতম সদস্য এই নদী। একেক দেশে তার একেক নাম। বহু নামে পরিচিত কথিত নৃত্যশিল্পী নদী।
পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী নদীর ১০টি নামের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিটি দেশে তার আলাদা নামে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। নদীর বাকি নামগুলো হলো, ইতি ওরফে জয়া আক্তার, জান্নাত ওরফে নূর জাহান। যশোর সীমান্ত এলাকা থেকে নদীর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।
মঙ্গলবার (২২ জুন) রাজধানীর তেজগাঁও ডিসি কার্যালয়ে এসব তথ্য জানিয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, এ চক্রের সদস্যরা পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে যশোর সীমান্তের একটি বাড়িতে রাখত। পরে সুযোগমতো ভারতে পাচার করত। পাচারকৃত প্রত্যেক মেয়ের জন্য স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এক হাজার টাকা করে নেন। পাচারকালে কোনো মেয়ে বিজিবির কাছে আটক হলে সেই ইউপি সদস্য তাকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. আল আমিন হোসেন, মো.সাইফুল ইসলাম, আমিরুল ইসলাম, পলক মন্ডল, মো. তরিকুল ইসলাম ও বিনাশ শিকদার।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজীব হোসেনের সঙ্গে নদীর বিয়ে হয়। ২০১৫ সালে রাজীব বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। এরপর নদী পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পাচারকৃত ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নদীর দশটির মতো নাম পাওয়া যায়। নদী ভারত, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের নারী পাচার চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন।
ডিসি শহিদুল্লাহ বলেন, পাচারের শিকার নারীদের কাছে তিনি নদী হিসেবে পরিচয় দিলেও ভারতে তাকে সবাই ইতি নামে চেনে। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। বাংলাদেশি পাসপোর্টে তার নাম নুর জাহান। সাতক্ষীরা সীমান্তে তার নাম জলি, যশোর সীমান্তে তিনি প্রীতি নামে পরিচিত। গ্রেপ্তার আল আমিন হোসেনের বাড়ি যশোর সীমান্তে। ২০২০ সালে ঈদ উল আযহার চারদিন পর নারী পাচার করতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে তিনি আহত হন। পাচারের উদ্দেশ্যে আনা মেয়েদেরকে তার বাড়িতে রেখে সুযোগমতো ভারতে পাচার করতেন।
গ্রেপ্তার সাইফুল ইসলামের শর্শার পাঁচভূলট বাজারে মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা আছে। মানব পাচারে জড়িত ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই, সবুজ, আল আমিন ও একজন ইউপি সদস্য তার মাধ্যমে মানবপাচার থেকে অর্জিত অর্থ বিকাশে লেনদেন করেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে তিনি মানবপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের সতর্ক করে দিতেন। তার বিকাশ ট্রানজেকশনে ব্যবহৃত মোবাইলটি জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার পলক মন্ডল যশোরের মনিরামপুর ঢাকুরিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গাহঘাটা থানার নলকড়া গ্রামে নানা বাড়িতে যান। সেখানে পঞ্চগ্রাম স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে BIAMS (Bachelor of Ayurvedic Medicine and Surgery) ডিগ্রি নিয়ে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। বেনাপোলের ইস্রাফিল হোসেন খোকন, ভারতে অবস্থানকারী বকুল ওরফে খোকন, তাসলিমা ওরফে বিউটি ও চক্রের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিতে আসা গ্রাম্য দরিদ্র মেয়েদেরকে ব্যাঙ্গালুরুতে তাসলিমা ওরফে বিউটির কাছে পাঠানোর মাধ্যমে নারী পাচারে তার হাতেখড়ি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত মেয়েদেরকে আধার কার্ড প্রস্তুত করে দেয়ার পাশাপাশি নিরাপদ ‘সেফ হোম’ এ অবস্থান এবং ব্যাঙ্গালুরুতে নির্ধারিত স্থানে পাঠানোর দায়িত্ব নেন তিনি।
এছাড়াও তিনি ভারতীয় আধার কার্ড ও ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ডধারী। উত্তর প্রদেশের গোরাক্ষপুর জেলার বড়ালগঞ্জ থানার নেওয়াদা গ্রামেও থাকতেন তিনি। তার কাছ থেকে তার ভারতীয় আধার কার্ড, ভারতের নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ড, ভারতীয় আয়কর বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত আইডি কার্ড, ভারতীয় সিম কার্ড ও একজন ভিকটিমের আধার কার্ড জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেফতার বিনাশ সিকদার নড়াইলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তিনি বেনাপোলে বাসা ভাড়া নিয়ে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করেন। তার স্ত্রী সোনালী সিকদার ভারতীয় নাগরিক। বেনাপোলে পাসপোর্ট ফরম পূরণের কাজ করতে গিয়ে ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আব্দুল হাই সবুজ ও মানব পাচারে জড়িত আরো কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
সেই পরিচয়ের সূত্রধরে বিনাশ মানব পাচারের জড়িয়ে পড়েন। যশোর ও নড়াইল থেকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরি বা প্রলোভন দেখিয়ে আনা নারীদেরকে ইস্রাফিল হোসেন খোকন, আল আমিন, তরিকুল, আমিরুল ও আরো কয়েকজনের মাধ্যমে সীমান্ত পার করে ভারতীয় দালালদের কাছে পৌঁছে দেয় সে। তার কাছ থেকে বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও দুটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে যেসব আধার কার্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে এসব ভারতীয়রা করেছেন নাকি বাংলাদেশি কেউ করে দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, এগুলো তৈরিতে ভারতীয় লোকেরা সহয়তা করেছে।
গ্রেফতাররা কতজনকে ভারতে পাচার করেছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার করেছি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বিস্তারিত জানতে পারবো।
নদীর সঙ্গে টিকটক হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী, হৃদয় বাবুসহ আরও দুই-একজনের নাম আগে উল্লেখ করেছিলাম। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের সহযোগিতায় তারা পাচার করেছে।
ভারতে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে ওই ভিডিওর সঙ্গে নদীর সম্পৃক্ততা কতটুকু? এ বিষয়ে তেজগাঁও ডিসি বলেন, টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে যেহেতু নদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, কাজেই ওই ভিডিওর সঙ্গেও নদীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।