১০ জুলাই ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি:
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কিশোরগঞ্জের একই পরিবারের ৬ জনসহ ১৪ শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করেছে তাদের পরিবার। কারখানার তিন তলা থেকে লাফিয়ে আহত অবস্থায় বেঁচে ফিরে এসেছে এক নারী ও এক পুরুষ।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেল ৫ টা ৪২ মিনিটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার নিচতলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর কারখানার ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ভবনের ভেতরে আটকে পড়েন আরো অনেক শ্রমিক। এখন পর্যন্ত নিখোঁজের তালিকায় কিশোরগঞ্জের ১৪ নারী-পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন।
নিখোঁজ শ্রমিকের তালিকায় রয়েছে- কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দানাপাটুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ কালিয়ান্দা গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম, কটিয়াদী উপজেলার গৌরীপুর গ্রামের তাসলিমা, রাবেয়াসহ চার নারী এবং একই ইউনিয়নের শিমুলতলা গ্রামের আরো দুই নারী-পুরুষ, করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের একই পরিবারের ছয়জন শায়েলা, রেহানা, জাহানারা, হাকিমা, মাহমুদা ও অহাদ এবং একই ইউনিয়নের মতুরাপাড়া বিলপাড় গ্রামের জাহানারা বেগম।
কারখানার তিন তলা থেকে লাফিয়ে পরে আহত অবস্থায় বেঁচে ফিরে এসেছেন জেলার কটিয়াদী উপজেলার গৌরীপুর গ্রামের আসমা আক্তার ও সোহাগ মিয়া।
সরেজমিনে শুক্রবার রাত ১২টায় জেলার সদর, কটিয়াদী এবং করিমগঞ্জ উপজেলার এ গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ এইসব শ্রমিকদের পরিবারের স্বজনদের আহাজারি-আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ।
সদর উপজেলার দানাপাটুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ কালিয়ান্দা গ্রামের নিখোঁজ শ্রমিক এসএসসি পরীক্ষার্থী নাজমুল ইসলামের বাবা চান মিয়া বলেন, দরিদ্র পরিবার হাওয়ায় এবং করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দুই মাস আগে ওই কারখানায় কাজের জন্য চলে যায় নাজমুল। যাতে আমার কষ্ট কিছুটা কম হয়। বুধবার মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো নাজমুলের কথা হয়। নাজমুল মাকে বলে চিন্তা করো না, ঈদে বেতন পেয়ে টাকা নিয়ে বাড়িতে আসব। তোমার জন্য বাবার জন্য ও ছোট দুই বোনের জন্য ঈদের পোশাক নিয়ে আসব। নাজমুল আর আসবে না। আর কোনোদিন আসবে না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কারখানার তিন তলা থেকে লাফিয়ে পরে আহত অবস্থায় বেঁচে ফিরে আসা জেলার কটিয়াদী উপজেলার গৌরীপুর গ্রামে আসমা আক্তার জানান, আমি তখন তিন তলায় সেমাইয়ের রুটি ভাঙার কাজ করছিলাম। হঠাৎ শুনি অফিসে আগুন লেগেছে। তখন সবাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি সেদিকেও আগুন জ্বলছে। তখন আমিসহ অনেকেই তিন তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এরপর আর কিছু মনে নেই। পড়ে দেখি হাসপাতালে।
জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের একই পরিবারের ছয়জন নিখোঁজ রয়েছে। সেই পারিবারের বৃদ্ধ অভিভাবক সলেম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আমার ছেলের বউ, মেয়ে ও নাতিসহ ছয়জনের খোঁজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো আগুনে পুড়ে সবাই মারা গেছে। আমার বড় ছেলে আবু বাক্কার সেখানে রয়েছে, তাদের খুঁজতেছে। জানি না কি হয়েছে। আমার এখন কি করব। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।
সদর উপজেলার দানাপাটুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন জানান, আমাদের এলাকার মেধাবী ছাত্র নাজমুল তার বাবাকে সহায়তা করার জন্য ওই কারখানায় কাজের জন্য যায়। আজ সে নিখোঁজ, হয়তো আগুনে পুড়ে মারা গেছে। আমাদের কিশোরগঞ্জের যারা নিখোঁজ বা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে সরকার যেন ক্ষতিপূরণ দেয় এটাই দাবি আমাদের।
করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজাম উদ্দিন বলেন, আমার ইউনিয়নের সাতজন শ্রমিক নিখোঁজ আছে। হয়তো সবাই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। সরকার ও কারখানা কর্তৃপক্ষ যেন তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয় যাতে এই অসহায় পরিবারগুলো চলতে পারে।
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের লোকদের হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি-আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে কিশোরগঞ্জে আকাশ-বাতাস।