১০ জুলাই ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ
কিছু বিতর্ক থাকে যা চিরন্তন, কিছু বৈপরীত্য থাকে যা শাশ্বত, কিছু আবেগ থাকে যা একান্তই আপন- সেখানে সমঝোতা চলে না। কিছু হলুদ কখনোই আকাশি-সাদা হয় না, আর আকাশি-সাদাও ভুল করে হলুদে রাঙায় না। মেরু আর মরু চাইলেও কাছাকাছি আসতে পারে না। তেমনি ফুটবলের মহাকাশেও মহাকালজুড়েই ভিন্ন কক্ষপথ বেছে নিয়েছে যে দুটি দল, সেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনালে কেনই বা উত্তুঙ্গ আবেগের আগ্নেয়গিরির মুখ হয়ে থাকবে না। পঞ্জিকা কী বলছে জানা নেই, তবে রোববার ভোরে ফুটবলের মহাকাশে যে ‘পূর্ণগ্রহণ’ হতে চলেছে, তা এতক্ষণে জেনে গেছে সবাই। বাংলাদেশ সময় ভোর ৬টায় কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মাঝে ফুটবল নামক ‘চর্মগোলক’ নব্বই মিনিট কিংবা তারও বেশি সময়ের জন্য হাজির হচ্ছে ‘সুপার ক্ল্যাসিকো দি লাস আমেরিকাস’।
চৌদ্দ বছর পর আবারও দুই লাতিন প্রতিবেশী কোপার ফাইনালে মুখোমুখি। একটা প্রকাণ্ড কাঁপুনিতে ফুটবলবিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে মারাকানা। সেই মারাকানা যেখানে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে চোখের জল মুছতে হয়েছিল মেসিকে, এটা ব্রাজিলের সেই পয়া মারাকানা যেখানে আগের কোপার ফাইনালেই সেলেকাওদের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। এবারও কি সে ভূমিপুত্র নেইমারদের জন্যই বুক পেতে রাখবে, নাকি ফুটবলের বরপুত্র মেসির জন্য তোলা রয়েছে তার ভালোবাসা- তা জানার জন্য হৃদয়ের একূল-ওকূল দু’কূল ছাপিয়ে অপেক্ষা করতে হবে গোটা বিশ্বকে। কে জিতবে এই ঐতিহ্যের লড়াই, কেই বা জিতবে এই শতাব্দীপ্রাচীন টুর্নামেন্টের এবারের শিরোপা? টুইটারে এখন পর্যন্ত পেলে নীরব। আর অন্য যে মানুষটি এ ম্যাচটি ঘিরে পূর্বাভাস দিতেন, সেই দিয়াগো আরমান্দো ম্যারাডোনা তো বুয়েনাস আয়ার্সের ঠিকানায় নেই। ওপার থেকেই তিনি হয়তো আশীর্বাদ করবেন মেসিকে। দেখতে চাইবেন, নিজের শেষ কোপা আমেরিকায় অন্তত দলের বাকি দশজন মিলে মেসিকে আর্জেন্টিনার হয়ে এই ট্রফিটি দিক। তিন-তিনবার কোপার ফাইনাল (২০০৭, ২০১৫, ২০১৬) উঠেও যিনি ট্রফির স্পর্শ পাননি, সেই মানুষটির যেন এবার শাপমোচন হয়। তাহলে অন্তত তাকে ওই খোটা শুনতে হবে না- আর্জেন্টিনার হয়ে কখনও কি শিরোপা জিতেছে সে? এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্রুশের মতো এ প্রশ্নটিই যে বিদ্ধ করে এসেছে তাকে। হৃদয়ের অতল থেকে প্রবলভাবে এ ইচ্ছাটি লালন করেই কাল ফুটবলের পূর্ণগ্রহণের ছায়াতলে থাকবে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা, আর ঠিক সে কারণেই এর বিপরীতটাই চাইবে ব্রাজিল সমর্থকরা। ২০১৩ কনফেডারেশন কাপ জেতা ছাড়া নেইমারের হাতেও তো ব্রাজিলের কোনো ট্রফি ওঠেনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলা ইতিহাস আর সংস্কৃতি বলে মেসির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্যেই সমাপ্ত হবে একটি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা অধ্যায়; যা শুরু হয়েছিল ২০০৭ থেকে মেসির আগমনের পর থেকে। তবে ইতিহাস বলে, দু’দলের স্নায়ুক্ষয়ের শুরু তাও প্রায় শতবছর আগে থেকে।
তখন আজকের ব্রাজিলের নাম ছিল ‘এম্পায়ার অব ব্রাজিল’ আর আর্জেন্টিনার ‘রিও জে লা প্লাতা’। সিসপ্ল্যাটাইন নামের একটি ভূখে র দখল নিয়ে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে ১৮২৫ সালে। প্রায় দু’বছর আট মাস স্থায়ী ছিল সেই লড়াই। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের মধ্যস্থতায় অবসান হয় সেই যুদ্ধের এবং সেই ভূখে ‘ইস্টার্ন রিপাবলিক অব উরুগুয়ে’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। সেই থেকেই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু। তারও বহু বছর পর। ১৯১৪ সালে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিল দুই লাতিন প্রতিবেশী। ৩-০ গোলে ওই ম্যাচটি জিতেছিল আর্জেন্টিনা (যদিও ফিফা সে ম্যাচটিকে স্বীকৃতি দেয়নি)। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক মাঠের ফুটবলে আধিপত্য দেখায় ব্রাজিল। তাদের ঘরোয়া ফুটবল সুগঠিত ও প্রচ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯২৫ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ ২-২ গোলে টাই হয়। তবে দু’দলের বৈরিতা বিশ্রীভাবে ফুটে ওঠে ফুটবল মাঠে। ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টিনার মাঠে ক্রিসমাস ডেতে। একটি ফাউলকে কেন্দ্র করে দু’দলের ফুটবলাররা লাথি-ঘুসির মতো মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের দেখাদেখি মাঠের ত্রিশ হাজার দর্শকও মারামারি শুরু করে দেয়। ওই ম্যাচের পর টানা ১১ বছর দু’দল আর মুখ দেখাদেখি করেনি। ১৯৩৭ সালে আর্জেন্টিনার দর্শকরা ব্রাজিলিয়ানদের বর্ণবাদী মন্তব্য ছুড়তে থাকলে সেলেকাওরা শেষ বাঁশি বাজার আগেই মাঠ ছাড়ে।
ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ম্যাচটির নাম দিয়েছিল ‘জোগো দ্য ভারগোনহা’ বা লজ্জার ম্যাচ। দু’বছর বাদে কোপা আমেরিকারই একটি ম্যাচে ফাঁকা পোস্টে গোলকিপার ছাড়াই ব্রাজিল একটি পেনাল্টি নিয়েছিল। কারণ সেই পেনাল্টির সিদ্ধান্ত পছন্দ না হওয়ায় পুরো দল নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল আর্জেন্টিনা। এই সেদিনও, মানে ১৯৯০ বিশ্বকাপেও একটি ঘটনা দু’দলের মধ্যকার বৈরিতার নমুনা শুনেছিল ফুটবলবিশ্ব। ব্রাজিলের ডিফেন্ডার ফ্রাঙ্কোকে পানীয়র সঙ্গে ট্র্যাঙ্কুলাইজার মিশিয়ে খাইয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফিজিও। এখনও সেই ম্যাচকে ‘দ্য হলি ওয়াটার স্ক্যান্ডাল’ বলে অনেক আর্জেন্টাইন। যদিও এখন আর সেই রেষারেষি নেই দু’দলের মধ্যে।
নেইমার আর মেসির বন্ধুত্বের কথা গোটা বিশ্ব জানে। তা ছাড়া দু’দলের খেলোয়াড়রাই এখন অনেক বেশি ইউরোপিয়ান ক্লাবমুখী। যে কারণে ওখানে গিয়ে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের চেয়েও নিজেদের তারা ‘লাতিন’ ভাবতে পছন্দ করেন। এখনকার শত্রুতা তাই শুধুই ওই ‘নব্বই মিনিটের’। যে কারণে সেমিতে পেরুকে হারিয়ে ব্রাজিল এবারের কোপার ফাইনালে ওঠার পর নেইমার বলতে পারেন- ‘আমি আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করি। কারণ ফাইনালে আমি শুধুই আর্জেন্টিনাকে চাই।’ প্রতি-উত্তরে মেসিও মুচকি হাসি দেন- ‘নেইমার কেন আমাদের সমর্থনের কথা বলেছে, তা আমি ভালোভাবে জানি। আমরা দু’জন খুব ভালো বন্ধু, তাই সে আমাদের ফাইনালে ওঠা মন থেকে চেয়েছে।’
মেসি কিংবা নেইমার দু’জনে শান্তির সাদা পতাকা তুললে কী হবে, যারা চিরকাল অমীমাংসিত বিতর্ক চালিয়ে আসছে, তারা কেন নীরব থাকবে। যুগে যুগে দু’পক্ষ তো শ্রেষ্ঠত্বের প্রশ্নে কে শীর্ষে- সেটাই খুঁজে এসেছে। সেই পেলে, জিকো,গারিঞ্চা নাকি ম্যারাডোনা, প্রেদেনেরা? রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা নাকি বাতিস্তুতা, রিকুয়েলমে, রেদেনোদা? কে সেরার জিজ্ঞাসা এসে ঠেকেছে মেসি নাকি নেইমারে? শুধু তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেননি কোনো পূর্বসূরি, খুঁজতে রাজি নন উত্তরসূরিরাও।
যেমন তারা রাজি নন ব্রাজিলের ‘জাগো বনিতো’ খুঁজতেও! সত্তরের দশক থেকে অনিন্দ্যসুন্দর ফুটবল খেলেই গোটা বিশ্বের মন পেয়েছে ব্রাজিল। ‘জাগো বনিতো’ লাতিন এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত বাঙালিরাও। কিন্তু এবার তিতের ব্রাজিল যেন কোপায় সেই নান্দনিকতা দেখাতে পারেনি। শুরুটা তারা করেছিল ভেনেজুয়েলাকে ৩-০ গোলে হারিয়ে। এরপর পেরুকেও দিয়েছিল চারটি। কিন্তু তার পরই যেন কিছুটা শৈল্পিক ফুটবল ছেড়ে ‘শ্রমিক’ ফুটবলে মন দিয়েছেন তিতে। এটা ব্রাজিলের মিডিয়াগুলোতেও সমালোচিত হয়েছে। কলম্বিয়া, ইকুয়েডরের সঙ্গে অনেকটাই যেন ধরে খেলেছেন নেইমাররা। অবশ্য এটাকেও নাকি আধুনিক ফুটবলের নতুন কৌশল বলে- ‘শক্তি সঞ্চয় করা’। আর সেটা নাকি ফাইনালের জন্যই তুলে রেখেছেন নেইমাররা। ব্রাজিল মানেই যে কোনো আসরের অলিখিত ফেভারিট- এটা বলতে অস্বস্তির কিছু নেই। তার ওপর আবার ঘরের মাঠে খেলা। যদিও দর্শকহীন মাঠে ঘরের মাঠ আর পরের মাঠের তফাত নেই। তার পরও মারাকানার প্রতিটি ঘাসই তো চেনা নেইমারদের। এবারের দলটিও গড়ছেন তিতে নেইমারকে কেন্দ্র করেই। তবে এবারের ব্রাজিল দলকে বোধহয় মেসি কিংবা আর্জেন্টিনা নয়, তাতিয়ে দিয়েছেন খোদ ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনেরই প্রধান রোজারিও কাবোক্লো।
ব্রাজিলে করোনার কারণে যখন কোপা আমেরিকা আয়োজন নিয়ে আদালতে গড়িয়েছে ব্যাপারটি। তখন কোচ তিতে মিডিয়ার সামনে এসে বলেছিলেন, তার দলের অনেকেই মহামারির মধ্যে এই আসর খেলতে চায় না। তার পরই ফুটবল সংস্থার প্রধান পাল্টা মিডিয়ার সামনে এসে তিতের নাম না নিয়ে বলেন- ‘কেউ যদি দায়িত্ব নিতে না চায় তাহলে সে সরে দাঁড়াক। আগে আমাদের সময় ব্রাজিলের হয়ে খেলার জন্য প্রত্যেক ফুটবলার গর্বিত বোধ করত। আর এখন…’ তার কথার ঠিক এখানেই লেগেছে নেইমার-থিয়াগো সিলভাদের। দলের প্রায় বেশিরভাগ ফুটবলারই ইউরোপে খেলেন, ছুটি নিয়ে তারা যখন কোপা আমেরিকা খেলতে এসেছেন তখন ফেডারেশন কর্তার ওই কথা ভালোভাবে নেননি জেসুস-ক্যাসেমিরোরা। তাই কোপা জিতে একটি মোক্ষম জবাব দিতে চান ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা। আর তা যদি হয় আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে, তাহলে তো কথাই নেই। সে কারণেই এ ম্যাচটি ঘিরে দারুণ ভাবে তেতে আছে সেলেকাওরা। ৪-২-৩-১, সেমিতে পেরুর বিপক্ষে এমনই ফরমেশন সাজিয়েছিলেন তিতে। রিচার্লিসনকে সামনে রেখে মিডফিল্ডে নেইমার, পাকুয়েতা আর এভারটনকে রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে দলের এক নম্বর গোলরক্ষক অ্যালিসনকে বসিয়ে খেলিয়েছিলেন অ্যাডারসনকে। যদিও ফাইনালে কৌশল বদলানোর ইঙ্গিত দিয়েছে ব্রাজিলিয়ান মিডিয়া। মেসিকে কড়া মার্কে রাখার জন্য দানিলো, মারকুইনহোস ও থিয়াগো সিলভার সঙ্গে আরও কাউকে অ্যাসাইনমেন্ট দিতে পারেন তিতে।
মেসিও নিশ্চয়ই জানেন সেটা। আর এজন্যই নিজে গোল করার চেয়েও বেশি মনোযোগ তার গোল করানোর। চারটি গোলের পাশাপাশি পাঁচটিতে অ্যাসিস্ট তার এ আসরেই। লাওতারো মার্টিনেজের ওপর প্রবল আস্থা তার। সেইসঙ্গে মিডফিল্ডার ডি পল, রদ্রিগুয়েজকে নিয়ে দারুণ একটা কম্বিনেশন তৈরি করে নিয়েছেন। ৪-৩-৩ ফরমেশনে এখনও সাফল্য পেয়েছে আর্জেন্টিনাইনরা। তবে আজকের ফাইনালে ডি মারিয়াকে নিয়েই অগ্নিপরীক্ষায় নামতে পারেন মেসি। হয়তো ম্যাচের সেরা একাদশেই ডি মারিয়াকে রাখবেন তিনি। হতে পারে শেষের কুড়ি মিনিট আগুয়েরোকে নামিয়েও একটা ঝড় তোলার আশায় আছেন। তবে আর্জেন্টিনা মানেই তো সহজ গোল মিসের আফসোস, আর ডিফেন্সের দুর্বলতা। যদিও মোলিনা, পিজ্জেলা, ওটামন্ডি আর ট্যাগলিফ্যালিকোকে দিয়ে দারুণ একটা দেয়াল এই আসরে তৈরি করেছে আর্জেন্টিনা। সেইসঙ্গে আছে গোলরক্ষক অ্যামিলিয়ানো মার্টিনেজ, আপাতত তার হাতকেই ‘ঈশ্বরের হাত’ বলে আপ্লুত আলবিসেলেস্তে সমর্থকরা। যদিও মেসি কিছুতেই চাইবেন না আর কোনো টাইব্রেক করে ট্রফির পাশ কাটিয়ে পুরস্কার মঞ্চে যেতে। চাইবেন না হৃদয় খুঁড়ে কান্না সামনে আনতে। একটি বার, অন্তত একটি বার তার ওই ট্রফিটি যে চাই-ই চাই। তা না হলে যে সূর্য নয়, সূর্যের আলোয় ওই চাঁদই হয়ে থাকতে হবে তাকে!