নিজস্ব প্রতিবেদক
২০২২ সাল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সুখের বার্তা নিয়ে এসেছে। অতীতে হয়নি বলে যে আগামীতে হবে না তা তো নয়? অতীতের সব ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সাফল্যার ইতিহাস রচনা করে চলেছে। নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে দীর্ঘ দুই দশকে যে জয় ছিল অধরা তা ধরা দিয়েছিল এই বছরের শুরুতে টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের মাধ্যমে। একই অবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও। এবার সেই খরাও দূর হয়েছে।
প্রথম ওয়ানডেতেই বাংলাদেশ বাজিমাত করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে ৩৬ রানে। সেঞ্চুরিয়ানে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে তিন ফিফটিতে ৭ উইকেটে ৩১৪ রান করার পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে আর সেই রান তাড়া করতে দেননি বাংলাদেশের বোলাররা। লক্ষ্য থেকে বহু দূরে ২৭৬ রানে আটকে পড়ে স্বাগতিকরা। এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের শীর্ষ স্থান আরো পাক্কা পোক্ত করেছে লাল-সবুজের প্রতিনিধরা। ১৬ ম্যাচে পয়েন্ট ১১০। দক্ষিণ আফ্রিকার পয়েন্ট ১১ ম্যাচে ৩৯।
ভান্ডারে তিনশোর্ধ রানের পূঁজি থাকলে যে কোন দলের বোলারদের পায়ের তলার মাটি অনেক শক্ত হয়ে যায়। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। হাত থেকে ম্যাচ ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কখনো লাগাম ছুটে গেলে তা আবার টেনে ধরার সুযোগ থাকে। সাকিব-লিটন-ইয়াসির-তামিমরা মিলে ৩১৪ রানের পুঁজি দেওয়ার পর তাসকিন-মোস্তাফিজ-শরিফুল-মিরাজরা টেনশনমুক্ত ছিলেন অনেকটা। এরকম অবস্থায় প্রতিপক্ষের কপালে থাকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। ভালো একটা শুরু হওয়া চাই-ই চাই। নতুব পথ হারাতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের তাসকিনরা একটিবারের জন্যও রাস্তা মসৃন হতে দেননি। পেস আর স্পিনের সম্মিলনে প্রোটিয়াদের ‘বধ’ করা হয়। শুরুতে পেস আক্রমণে আঘাত, পরে স্পিনের ভেল্কি।
ব্যাটিং পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে মাঝেই ৩ উইকেট তুলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানদের উপর তাসকিনরা সেই যে গরম নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করেন, তা আর ঠান্ডা হতে দেননি। তাসকিন দুইটি, শরিফুল একটি উইকেট তুলে নেন। এরপর যখনই জুটি গড়ে উঠেছে, কিংবা ব্যক্তিগতভাবে কেউ দাঁড়িয়ে গেছেন, তাতে শঙ্কিত হননি বাংলার বোলাররা। কেউ না কেউ এসে আঘাত হেনেছেন। এই যেমন চতুর্থ উইকেট জুটিতে টেম্বা ও ডসন মিলে ৮৫ রান যোগ করে ম্যাচে ফেরার ইংগিত দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনই শরিফুল এসে টেম্বাকে ফিরিয়ে দেন। এরপর দাঁড়িয়ে যান ডসন। সঙ্গে পেয়ে যান মিলারকে। মিলার কিছু আক্রমণাত্বকও ছিলেন। ফিরতে স্পেলে বল হাতে তুলে নিয়ে তাসকিন ফিরিয়ে দেন ডসনকে ৮৬ রানে। এরপর শুরু হয় মিরাজের ভেল্কি। একটি করে উইকেট নিতে থাকেন আর বাংলাদেশের জয়ের আভা ক্রমেই ফুটে উঠতে থাকে। মিরাজ শুরুটা করেন ফেলুকায়োকে আউট করে। এরপর পটাপট তুলে নেন জনসন ও রাবাদাকে। তখনো মিলার একাই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখে ভালো লাগেনি মিরাজের। ব্যস, তাকেও ফাঁদে ফেলেন মুশফিকুর রহিমের মাধ্যমে স্ট্যাম্পিং করে ৭৯ রানে। মিরাজের ভেল্কিতে স্বাগতিকদের রান ৬ উইকেটে ২০৬ রান থেকে পরিণত হয় ৯ উইকেটে ২৪২। হার নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর শেষ উইকেট জুটিতে কেশন মহারাজ (২৩) ও এনগিডি (অফরাজিত ১৫) ঝড়ো ব্যাটিং করে দলের ৩.২ ওভারে ৩৪ রান যোগ করে বড় হারের ব্যবধানকে কমিয়ে আনেন।
হোক মন্থর শুরু। ভীতটা মজবুত হলে সেখানে দাঁড়িয়ে শক্ত পূঁজি দাঁড় করানো যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশ তাই করেছে। তামিম (৪১)-লিটনের (৫০) উদ্বোধনী জুটিতে ২১.৩ ওভারে ৯৫ রানের জুটির উপর দাঁড়িয়ে সাকিবের ৭৭ আর ইয়াসির আলীর ৫০ রানে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে করেছে ৩১৪ রান। এই রান দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের দলগত সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে তেরতম সর্বোচ্চ ইনিংস। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ২০১৭ সালে কিম্বারলিতে ৭ উইকেটে ২৭৮। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান ছিল ৬ উইকেটে ৩৩০। ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ওভালে এই রান করে বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছিল ২১ রানে।
টস হেরে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল খুবই মন্থর। ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে আসে মাত্র ৩৩ রান। ৫০ রানে আসে ১৫.১ ওভারে। শতরান ২১.৫ ওভারে। এ সময় উইকেট পড়ে শুধুই একটি তামিম ইকবালের। পরবর্তিতে রানের চাকা সচল হয় সাকিব ও ইয়াসির আলী ব্যাটে আর জুটিতে। দুই জনেই খেলেন মারমুখি ইনিংস। পরবির্ততে মাহমুদউল্লাহ, আফিফ, মিরাজম তাসকিনও একশর উপরে স্ট্রাইক রেটে রান সংগ্রহ করলে বাংলাদেশের সংগ্রহ তিনশ ছাড়িয়ে যায়। ৩০ ওভার শেষে রান ছিল ৩ উইকেটে ১৩৫। সে হিসেবে পরের ২০ ওভার রান যোগ হয় ১৭৯। শেষ ১০ ওভার ৯১। শেষ ৫ ওভারে ৪৮। এভাবেই রানের পাগলা ঘোড়া ছুটেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বাংলাদেশের রেকর্ড মলিন। সেখানে মলিনতা দূর করার একটা সুপ্ত ইচ্ছে মনে লালন করে মাঠে নামে বাংলাদেশ দল। সেঞ্চুরিয়ানের এই মাঠে টস জিতে বোলিং করাটাকেই বেছে নেন ক্যাপ্টেনরা। দক্ষিণ আফ্রিকার কাপ্তান টেম্বা তাই করেন। অবস্থা বুঝে তামিম-লিটনও সাবধানী সূচনা করেন। উদ্বোধনী জুটিতে তাদের ৯৫ রান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যে কোনো জুটিতে সেরা। তামিম রান খরা কাটিয়ে ৪১ রান করে ফেরুকাওয়ের নিচু হয়ে আসা বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে বিদায় নিলেও লিটন দাস হাফ সেঞ্চুরি করেই ফিরেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ দুই ওয়ানডেতে ১৩৬ ও ৮৬ রান করার পর সেই ফর্ম টেনে নিয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। ৬৬ বলে পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি করার পরের বলেই তিনি আউট হয়ে যান কেশব মহারাজের বলে বোল্ড হয়ে। মুশফিক (৯) এসে টিকতে না পারলেও সাকিব ও ইয়াসির আলী মিলে উপহার দেন শতরানের জুটি। দুই জনে মারমুখি ইনিংস খেলেন। দুই জনে জুটিতে ২৩.৩ ওভারে যোগ করেন ১১৪ রান।
শারীরিক ও মানসিক অবসাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিক সফরে যেতেই চাননি সাকিব। অনেক নাটকের পর শেষ পর্যন্ত গেলেন। আর প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই করেছেন বাজিমাত। হয়েছেন ম্যাচ সেরা। ব্যাট হাতে খেলেন ৭৭ রানের ইনিংস। তাও ৬৪ বলে ৩ ছক্কা ও ৭ চারে। ৫০ বলে ক্যারিয়ারের ৫০তম ৫০ করেন সাকিব। আইপিএলে দল না পাওয়ার পর বিপিএলের শেষ দুই ম্যাচ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে রানই পাননি। সেই দুঃসময় বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই পোস্টার বয়। ৫০তম ফিফটি করার পর সাকিব আরো বেশি মারমুখি হয়ে উঠেন। আউট হওয়ার আগে ১৪ বলে যোগ করেন আরো ২৭ রান। আউট হন এনগিডির বলে এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে। পরে বল হাতে ইনিংসের উদ্বোধন করে ১০ ওভারে ৬৩ রান দিয়ে কোন উইকেট না পেলেও ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনিই। সাকিব আউট হওয়ার ৪ রান পরই ইয়াসির আলীও আউট হন। ৪৩ বলে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি করে রাবাদার পরের বলেই আউট হন তারই হাতে ক্যাচ দিয়ে। তার ইনিংসে ছিল ২টি ছক্কা ও ৪টি চার। এরপর ইনিংসে তিনশ ছাড়িয়ে নেয়ার কাজটি করেন মাহমুদউল্লাহ ১৭ বলে ১টি করে চার ও ছক্কা মেরে ২৫, আফিফ ১৩ বলে ১টি করে চার ও ছক্কা মেরে ১৭, মিরাজ ১৩ বলে ২ ছক্কায় অপরাজিত ১৯ ও তাসকিন ৫ বলে ১ চারে অপরাজিত ৭ রান করে। দক্ষিণ আফ্রিকার মার্কো জেনসন ৫৭ ও কেশব মহরাজ ৫৬ রানে ২টি করে উইকেট। রাবাদ ৫৭, ফেলুকাওয়ে ৬৩ ও এনগিডি ৭৫ রানে নেন ১টি করে উইকেট।