১০ জুন ২০২১, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ
বিবর্তনের শুরু থেকে পৃথিবী জুড়ে এই সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে রয়েছে হাজারো জনশ্রুতি, কল্পকাহিনি ও কুসংস্কার। আমাদের দেশে অনেকে বলেন, গর্ভাবস্থায় কোনো নারী সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণের সময় যদি কিছু কাটাকাটি করেন তাহলে গর্ভের সন্তানের নাকি অঙ্গহানি হয়। আসলে এগুলোর সবই এক শ ভাগ কুসংস্কার। আসলে প্রকৃতির এক অনন্য, অনবদ্য ও খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা হচ্ছে এই সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণ। এখানে ভিত্তিহীন গল্পগাথা বা কুসংস্কারের কোনো জায়গা নেই।
পৃথিবী ও চাঁদ একটি নির্দিষ্ট নিয়মে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে এবং এর ফলে সূর্যের বিপরীতে পৃথিবী এবং চাঁদের অবস্থান প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন হতে হতে চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী যখন একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে অবস্থান নেয় তখনই হয় সূর্য অথবা চন্দ্রগ্রহণ। ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলা যায়—আমার মুখে যদি কেউ টর্চের আলো ফেলে আমার ছায়া পড়বে আমার পেছনে। আবার আমার পিঠে আলো ফেললে ছায়া পড়বে আমার সামনে। এভাবে চাঁদ যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে, সূর্য তখন চাঁদের ওপর সরাসরি আলো ফেলে। এর ফলে চাঁদের ছায়া সোজা গিয়ে পড়ে পেছনে থাকা পৃথিবীর ওপর। পৃথিবীর যে অংশে চাঁদের এই বিশাল ছায়া পড়ে, দিনের বেলাতেই সেই অংশ অন্ধকার হয়ে যায়। আর ওখান থেকে সূর্যের দিকে তাকালে মনে হবে যে সূর্য অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আসলে সূর্য অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে না বা কোনো রাক্ষসও সূর্যকে গিলে ফেলছে না। প্রকৃতপক্ষে এখানে চাঁদ সূর্যের বরাবর আসায় সূর্য চাঁদের আড়ালে চলে যায়। চাঁদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে কখনো চাঁদ পুরোপুরি অথবা কখনো আংশিকভাবে সূর্যকে আড়াল করে। একেই আমরা যথাক্রমে পূর্ণ ও আংশিক সূর্যগ্রহণ বলি।
সূর্য কিন্তু চাঁদের চেয়ে ৪০০ গুন বড়। তবু আমাদের চাঁদ পুরো সূর্যকে আড়াল করে দিতে পারে। এটা সম্ভব হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে, সূর্য যেমন চাঁদ অপেক্ষা ৪০০ গুন বড় ঠিক তেমনিভাবে সূর্য পৃথিবী থেকে চাঁদের চেয়ে ৪০০ গুন দূরে অবস্থিত। এই কারণে পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের আকার আমাদের কাছে সমান মনে হয়। সূর্যগ্রহণের সময় সূর্য থেকে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ অতিবেগুনি রশ্মি ছড়ায়। তাই এই সময় খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকালে চোখের ক্ষতি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
সূর্যগ্রহণে যেসব কুসংস্কার মানবেন না:
সূর্য গিলে খাচ্ছে ড্রাগন চৈনিক সভ্যতাসহ বেশ কিছু আমেরিকান ও ইউরোপীয় সভ্যতায় সূর্যগ্রহণের কারণ হিসেবে ড্রাগনের উল্লেখ আছে। ‘গেম অব থ্রোনস’-এর কল্যাণে পুরাকথার এই কল্পিত ড্রাগন স্থান করে নিয়েছে মানুষের কল্পনাতেও। প্রাচীন মায়া সভ্যতা ছাড়াও ‘নেটিভ’ আমেরিকানদের ‘চাকো’ জনগোষ্ঠীতে এখনো ড্রাগনের গল্প প্রচলিত।
প্রসূতি মায়েদের ভয় সূর্যগ্রহণের সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপারে দুই ধরনের গপ্প শুনতে পাওয়া যায়। এক, শিশুটি অসুস্থ হবে এবং দুই, শিশুটি চালাক হবে। তবে এ দুটি ধারণার কোনোটার ক্ষেত্রেই বিশ্বাস করার মতো যুক্তি বা তথ্য পাওয়া যায় না। প্রাচীন অ্যাজটেক সভ্যতায় বিশ্বাস করা হতো, চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের এক টুকরো খেয়ে ফেলা হয়। ম্যাক্সিকান সংস্কৃতিতে এটা বিশ্বাসে পরিণত হয়, প্রসূতি মা সূর্যগ্রহণ দেখলে তার অনাগত সন্তানের এক টুকরো খেয়ে নেবে দেবতারা!
কাত হয়ে শুতে বারণ সূর্যগ্রহণে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের শান্তি নেই। সেন্ট লুইসে অবস্থিত মার্সি হাসপাতালের গাইনোকোলজিস্ট শাফিয়া ভুট্টোর মতে, সূর্যগ্রহণের সময় পাকিস্তানে মায়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চিত করে শোয়ানো হতো। নইলে নাকি গর্ভের শিশু বিকলাঙ্গ হয়! বাংলাদেশেও এ ধারণার অস্তিত্ব রয়েছে। তবে গর্ভে শিশুকে রেখে চিত হয়ে শোয়াটা মায়েদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
ধাতব অলংকার পরা, খাবার ও টয়লেটে বারণ ধাতব অলংকার পরতে বারণ করা আছে ‘অ্যাস্ট্রোসেইজ’ নামে এক জ্যোতির্বিদ্যা সাইটে। অন্যদিকে ম্যাক্সিকান কুসংস্কারে, গ্রহণ চলাকালীন ধাতব অলংকার পরাকে উৎসাহিত করেছে। মেক্সিকোর প্রসূতি মায়েরা পেটের কাছে ধারালো ছুরি রাখতেন যেন গ্রহণের সময় সন্তানকে ঠোঁট কাটা রোগ থেকে বাঁচানো যায়। প্রচলিত আছে, সূর্যগ্রহণের ১২ ঘণ্টা এবং চন্দ্রগ্রহণের ৯ ঘণ্টা আগে থেকে খাবার গ্রহণ করা বারণ। এ সময় যৌন সংসর্গ বারণ, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মলমূত্র ত্যাগেও। তবে এসব ধারণার সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ নেই এবং নিশ্চিত ভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
যেটি মানবেন
সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো বারণ। এটি অবশ্যই মানবেন। সত্যি বলতে, যেকোনো সময়েই সূর্যের দিকে সরাসরি তাকাতে নেই। সে হোক গ্রহণের সময়, কিংবা স্বাভাবিক সময়ে। সূর্যগ্রহণ দেখতে কাঁসার পাত্রে পানি থেকে শুরু করে ব্যবহার হয়েছে কাজে লাগে না এমন এক্স-রে প্লেটও। এখন অবশ্য বিশেষ রোদচশমা দিয়ে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। সূর্যগ্রহণ নিয়ে কোনো কুসংস্কারে পাত্তা দেওয়ার কোনো মানে নেই