ঢাকা, শনিবার, ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ (আইটি ডেস্ক) : কোনো বিশেষ বস্তু, বিষয় বা ঘটনায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়া, এবং সেজন্য সেই ব্যাপারগুলোকে এড়িয়ে চলার প্রবণতাকে বলা হয় ফোবিয়া। কারো উচ্চতাভীতি থাকে, কারো পানিতে ভয় থাকে। এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের এক বা একাধিক বিষয়ে ফোবিয়া বা ভীতি আছে। এদিকে প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। প্রযুক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, সেই প্রযুক্তির ব্যাপারেও কিছু মানুষের ভয় ও আতঙ্কের শেষ নেই। মানুষের প্রযুক্তিবিষয়ক এসব ভীতির নাম ‘টেক ফোবিয়া’।
‘টেকনোফোবিয়া’ শব্দটির প্রথম আগমন ঘটে শিল্প বিপ্লবের (১৭৬০-১৮৪০) সময়। তখন থেকেই ইউরোপীয় শিল্প-কারখানায় মানুষের বিকল্প হিসেবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যায়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটেছে, এবং সেগুলোর একেকটি একেকভাবে মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে। সেই সকল ভীতির একটি সামষ্টিক রূপকে অভিহিত করা হয় ‘টেক ফোবিয়া’ হিসেবে। টেক ফোবিয়া’র নানা প্রকারভেদ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ফোবিয়াগুলো হলো : সাইবার ফোবিয়া, সেলফি ফোবিয়া, এক্সপেন্সিভ টেকফোবিয়া, ফরমাসপাস ফোবিয়া, নোমোফোবিয়া।
১. ফোমো (FOMO) ফোবিয়া অথবা ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমাদের অনেকের জীবনটাই যেন একটি খোলা বইয়ের মতো হয়ে উঠেছে। আমরা প্রতিনিয়ত কী করছি, কী খাচ্ছি, কী পরছি, কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে আড্ডা দিচ্ছি- সবকিছুর আপডেট দিতে থাকি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামে। এর মাধ্যমে আমরা একধরনের মানসিক শান্তি পাই বটে। কিন্তু কখনো এটিই হতে পারে চরম মানসিক অশান্তির কারণ। আপনার বন্ধুরা হয়তো সবাই মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে গেছে। যেকোনো কারণেই হোক আপনি যেতে পারেননি। যদি দেখা যায়, এরপর আপনি ফেসবুকে ঢুকতেও ভয় পাচ্ছেন, কারণ আপনার মনে হচ্ছে, ফেসবুকে ঢুকলেই তাদের আনন্দ করার ছবি, পোস্ট ইত্যাদি আপনার চোখে পড়বে, এবং তখন হয়তো আপনার মনে হবে, আমি খুব বড় কিছু মিস করছি, আফসোসও হবে, কেন আমি গেলাম না, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আপনি ফোমো (FOMO) ফোবিয়া অথবা ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’-এ আক্রান্ত।
২. সাইবার ফোবিয়া
কম্পিউটার ব্যবহারের ব্যাপারে অনেকের মনে অহেতুক ভয় কাজ করে, যার নাম হলো সাইবার ফোবিয়া। এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ মনে করে, যেহেতু তারা ইতোপূর্বে কখনো কম্পিউটার ব্যবহার করেনি, তাই এখনো তারা এ যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারবে না। এজন্য তারা সবসময় চেষ্টা করে কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কোনো কাজ দেওয়া হলে সেটি এড়িয়ে যেতে।
এধরনের মানুষকে যদি কম্পিউটারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে তার মধ্যে মাথাব্যথা, দুর্বল অনুভব করা, মানসিক উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া, মৃত্যুভীতি সৃষ্টি হওয়া, প্রচুর ঘাম হওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো বেশকিছু উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। যতক্ষণ তারা কম্পিউটারে কাজ করে, ক্রমাগত তাদের মধ্যে অস্বস্তি হতে থাকে, এবং কারো কারো ক্ষেত্রে তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলে।
৩. সেলফি ফোবিয়া
আজকালকার দিনে হাতে একটি স্মার্টফোন আছে, অথচ সেলফি তোলেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে, ভিন্ন চিত্রও কিন্তু আছে। অনেকেই চায় সেলফির মাধ্যমে নিজের খুব সুন্দর কোনো ছবি তুলতে। কিন্তু যখন তাদের ছবি ভালো আসে না, কিংবা তাদের চেহারা বিকৃত হয়ে যায়, তখন সেলফির প্রতি তাদের মনে একধরনের বিতৃষ্ণা জন্মায়। ফলে পরবর্তী সময়ে সেলফি তুলতে তারা ভীত বোধ করে।
৪. এক্সপেন্সিভ টেক ফোবিয়া
কোনো প্রযুক্তির পেছনে অতিরিক্ত অর্থ খরচের ভীতিই হলো ‘এক্সপেন্সিভ টেক ফোবিয়া’। কেউ যদি বিশেষ কোনো প্রযুক্তি ভালোভাবে ব্যবহার করতে না পারেন, তাহলে সেটির মাধ্যমে পয়সা উসুল হবে না বরং টাকাগুলো নষ্ট হবে, এমন চিন্তা তাদের মনে জেঁকে বসে। এমন ফোবিয়ার কারণে অনেকের পক্ষেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও খুব দামি কোনো প্রযুক্তি কিনে ফেলা সম্ভব হয় না।
৫. ফরমাসপাস ফোবিয়া
প্রায়ই আমরা নিজেদের বিভিন্ন আইডির পাসওয়ার্ড ভুলে যাই। পরে ফরগেট পাসওয়ার্ড অপশনটি দিয়ে নতুন একটি পাসওয়ার্ড সেট করে নিই। অনেকেই আছেন যারা পাসওয়ার্ড হারিয়ে ফেলা নিয়ে ভীত থাকেন। হতে পারে সেটি মোবাইলের লক পাসওয়ার্ড, মূল মেইল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড, কিংবা ঘরের দরজা খোলার পাসওয়ার্ড। এসব পাসওয়ার্ড একবার হারিয়ে ফেললে নিশ্চিতভাবেই প্রচুর বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এটা নিয়ে যারা সহজেই ভয় পায় বা উদ্বিগ্ন হয়, তারা ফরমাসপাস ফোবিয়ার শিকার হয়।
৬. নোমো ফোবিয়া
নোমো ফোবিয়া হলো নিজের মোবাইল ফোন ছেড়ে দূরে থাকার ভয়। ‘নোমো’ শব্দটি মূলত ‘নো মোবাইল’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের পোস্টঅফিস এই বিশেষ ফোবিয়াটির নামকরণ করে। সেখানকরা কর্মীদের মধ্যে যারা মোবাইল ব্যবহার করত, তাদের মধ্যে বিভিন্ন উদ্বেগে ভোগার প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্নভাবে আলোচনার পর দেখা যায়, তাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগটি আসলে মোবাইল ফোন হারানো নিয়েই।
নোমোফোবিয়ারও বিভিন্ন নতুন শ্রেণিবিভাগ তৈরি হয়েছে। যেমন- কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল ফোন চেক করে দেখা নতুন কোনো মেসেজ বা কল এলো কি না। এ প্রবণতাটি কমবেশি সবার মধ্যেই বিদ্যমান। আবার অনেকে অবসেসড থাকে তার মোবাইলের ব্যাটারি নিয়ে। হয়তো ১০০ শতাংশ চার্জ আছে মোবাইলে, তবু তাদের মনে ভয় হতে থাকে, মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাবে না তো! আর নোমোফোবিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো মোবাইল হারিয়ে ফেলা বা চুরি যাওয়ার ভয়।
৭. টেলিফোনোফোবিয়া
সরাসরি টেলিফোন যন্ত্রটির প্রতি ভীতি নয়, বরং টেলিফোনে কথা বলার প্রতি ভীতিই হলো টেলিফোনোফোবিয়া। আজকাল অনেকের মধ্যেই এই ফোবিয়াটি দেখা যায়। তারা হয়তো সামনাসামনি খুব বন্ধুত্বপরায়ণ। এমনকি মেসেজ লিখেও খুব ভালো করেই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করে। তারা ভাবে, তারা হয়তো গুছিয়ে কথা বলতে পারবে না কিংবা তাদের কথা শুনে অপর প্রান্তের মানুষটি তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে না, তার সমালোচনা করবে। এ কারণে অনেকে এমনকি রাইড বুকিং করা কিংবা খাবার অর্ডার দেয়ার মতো সংক্ষিপ্ত ফোনকলও করতে পারে না।
৮. নোইন্টারনেটফোবিয়া
ইন্টারনেট কানেকশন না পাওয়া বিষয়ক এই ফোবিয়াটি অনেকেরই আছে। শহরের বাইরে যাওয়ার সময় অনেকের মনেই আশঙ্কা জাগে, যদি নেটওয়ার্ক ভালো না থাকে? গরমকালে বারবার লোডশেডিং হয়, তাই ওয়াইফাই ব্যবহারকারীদের এক সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠায় থাকতে হয়, লোডশেডিং হয়ে ইন্টারনেট কানেকশনটাও চলে যাবে না তো!
এসব ফোবিয়া শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতিসাধন করে। প্রযুক্তি বিভিন্নভাবে মানুষকে সহায়তা করে। তাই প্রযুক্তিকেন্দ্রিক ফোবিয়াগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই হতে পারে সমাধান।