• বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৬ অপরাহ্ন

দুই দম্পতির অভিনব বিমান ছিনতাইয়ের চাঞ্চল্যকর কাহিনি

রিপোর্টার : / ২০৬ বার পঠিত
আপডেট টাইম : সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০

৭ ডিসেম্বর ২০২০, আজকের মেঘনা. কম, ডেস্ক রিপোর্টঃ

ছিনতাইয়ের ঘটনাটা ছিল নজিরবিহীন ও চাঞ্চল্যকর। ছিনতাইকারী দলে ছিল তিনজন পুরুষ, দুজন নারী ও তিনটি বাচ্চা। তাদের নির্দেশে আমেরিকার ডেল্টা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান আটলান্টিকের ওপর দিয়ে উড়ে নামে মায়ামিতে।

প্রাপ্তবয়স্ক ওই ছিনতাইকারীরা আর কখনও ফিরে যায়নি আমেরিকায়, এদের চারজন ফ্রান্সের স্থায়ী বাসিন্দা হন। খবর বিবিসি।

সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। মায়ামি বিমানবন্দরের টারম্যাকে দাঁড়ানো ছিল ডেল্টা এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-এইট বিমান। সাঁতারের পোশাক পরা এক ব্যক্তি বিমানবন্দরের গাড়ি নিয়ে বিমানটির কাছে থামল। গাড়ি থেকে নামল আরেকজন- তারও সাঁতারের পোশাক পরা। হাতে নীল ভারি একটা স্যুটকেস। হেঁটে গিয়ে বিমানের খোলা দরজার নিচে সে দাঁড়াল। একটা দড়ি নেমে এল। দড়িতে বেঁধে স্যুটকেসটা তুলে নেয়া হল বিমানে। স্যুটকেসের ভেতর ছিল এক মিলিয়ন ডলার।

সাঁতারের পোশাক পরা দুই ব্যক্তি ছিলেন মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ছিনতাইকারীরা তাদের সাঁতারের পোশাক পরে আসতে বাধ্য করেছিল। তাদের পরনে শুধু সাঁতারের জাঙ্গিয়া থাকলে নিঃসন্দেহ হওয়া যাবে যে তাদের কাছে কোনরকম অস্ত্র নেই। পরে অবশ্য এদের একজন দাবি করেন যে তার জাঙ্গিয়ার ভেতরে একটা বন্দুক লুকানো ছিল।

ডেল্টা এয়ারলাইন্সের এমন একটি ফ্লাইট বেছে নিয়েছিলেন ছিনতাইকারীরা যেটি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পুরো রুটে যাত্রা করতে সক্ষম ডলারের অঙ্কটা গুণে নিশ্চিত হবার পর ডেট্রয়েট থেকে বিমানে ওঠা ৮৬ জন যাত্রীকে মুক্তি দেয়া হয়। এবং খালি বিমানটি আবার আকাশে ওড়ে। বস্টন হয়ে বিমানটি উত্তর আফ্রিকার দিকে যাত্রা করে।

দিনটা ছিল ১৯৭২ সালের ৩১শে জুলাই। এটা ছিল ছিনতাইকারীদের এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার আলজেরিয়ায় ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির সদর দফতরে পৌঁছানোর চেষ্টা। সেই সময় আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ছিল ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি। ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার দুজন ছাত্র এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

ছিনতাইকারীদের মধ্যে ছিলেন এক দম্পতি, ২৪ বছর বয়সী মেলভিন ম্যাকনেয়ার এবং তার ২৬ বছর বয়সী স্ত্রী জিন। সাত বছর আগে নর্থ ক্যারোলাইনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যখন তাদের প্রথম আলাপ হয়, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি, তারা চাঞ্চল্যকর বিমান দস্যুতায় জড়িয়ে অভিযুক্ত হবেন, যে অভিযোগে দোষ প্রমাণ হলে সাজা সর্বনিম্ন বিশ বছরের জেল, সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।

ম্যাকনেয়ার বড় হয়েছিলেন নর্থ ক্যারোলাইনার গ্রিন্সবরোতে। দারুণ বেসবল খেলোয়াড় ছিলেন এবং কৃষ্ণাঙ্গ লিগে তার দল সে রাজ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে খেলত না। তাই কৃষ্ণাঙ্গদের আলাদা লিগ ছিল- এটাই ছিল তখন দস্তুর, তিনি বলছিলেন।

তিনি আমেরিকান ফুটবলেও তুখোড় ছিলেন এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট কলেজে খেলাধুলার স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করতেন। এরপর ১৯৬৮সালে মার্টিন লুথার কিং আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর তিনি দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েন। ম্যাকনেয়ারকে ফুটবল দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, তার স্কলারশিপ বন্ধ করে দেয়া হয়। লেখাপড়ারও সেখানেই ইতি ঘটে।

এরপরের বছর তাকে যখন মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়, তিনি দেখতে পান প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের প্রকৃত চেহারা, ম্যাকনেয়ার বলেন।তিনি যখন বার্লিনে মোতায়েন ছিলেন, সেখানে সেনা ছাউনিতে তিনি দেখেছেন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের দাপট। তাদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ সহ-সৈনিকদের নিগ্রহ ও প্রহারের দৃশ্য।

“বর্ণ বৈষম্য রেখে ঢেকে করা হতো না, ফলে আমরা জঙ্গী পথ নিয়ে আলাপ শুরু করলাম। আমরা কর্মকর্তাদের স্যালুট না করে পরোক্ষ প্রতিবাদ শুরু করলাম, কালো বাহু-বন্ধন পরতাম, চুল লম্বা করলাম এবং জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাঁড়াতাম না,” তিনি বলেন। “আমেরিকায় গড়ে ওঠা ব্ল্যাক প্যান্থার দল আন্তর্জাতিক পরিসরে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে তখন কাজ করছিল। ওদের দলের সদস্যরা বার্লিনে এল, আমাদের সাথে কথা বলল, আমাদের দলে নিয়োগ করল। তখনই আমি ব্ল্যাক প্যান্থারে যোগ দিলাম।”

জিন, মেলভিনের সাথে যোগ দিলেন বার্লিনে। ১৯৭০এ মেলভিনকে বলা হলো তাকে কিছু দিনের মধ্যেই ভিয়েতনামে যুদ্ধে যেতে হবে। জিন তখন আসন্ন-প্রসবা। কয়েকদিনের মধ্যে তাদের প্রথম সন্তান জন্মাবে। বছর তখন শেষ হতে চলেছে। সেনা বাহিনীকে মেলভিন জানান তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে থাকাকালীন তার পরিবারের আমেরিকায় থাকার ব্যবস্থা করতে তাকে আমেরিকা ফিরতে হবে।

আমেরিকা ফিরে মেলভিন সেনা বাহিনী থেকে পালান। ডেট্রয়টে তারা আত্মগোপন করেন। ডেট্রয়ট তখন কৃষ্ণাঙ্গ জঙ্গীদের আখড়া। সেখানে যে বাসাবাড়িতে তারা আশ্রয় নেন, সেখানে থাকতেন আইন ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো আরও দুই ব্যক্তি। এদের একজন ছিলেন জর্জ রাইট। পেট্রল স্টেশনে ডাকাতির চেষ্টা ও স্টেশনের মালিককে খুনের দায়ে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। মেলভিন আর জিন সেটা জানতেন না। বাসার দ্বিতীয় বাসিন্দা ছিলেন জর্জ ব্রাউন। একদিন তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হবার পর তারা সবাই আমেরিকা ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিন্তু কোথায় যাবেন? তাদের মাথায় এল – আলজেরিয়ার কথা। ব্ল্যাক প্যান্থার আন্দোলনের একজন নেতা এলরিজ ক্লিভার আমেরিকার আইন থেকে পালাতে তখন আলজেরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে তিনি দলের একটি শাখাও খুলেছেন।

কিন্তু কীভাবে যাবেন? তারা একটা ফন্দি আঁটলেন। সত্তরের দশকের গোড়ায় জঙ্গী কার্যকলাপের একটা সহজ পথ ছিল ছিনতাই। ম্যাকনেয়ার বলছেন তিনি ছিনতাই নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে তিনি সময় কাটাতে লাগলেন, দেখতে লাগলেন ছিনতাই করতে গেলে কোথায় নজর রাখতে হবে, কোথায় কড়াকড়ি, কোথায় ফাঁকফোকর।

তিনি বলছেন, বুঝলাম আমাদের এমন একটা বিমান বেছে নিতে হবে যেটা পুরো রুটে যাত্রা করবে এবং আটলান্টিক মহাসাগর পার হতে পারবে। সেই বিবেচনাতেই আমরা ওই ফ্লাইটটা বেছে নিয়েছিলাম। তারা সবাই ছদ্মবেশ নিলেন। জর্জ রাইট পাদ্রী, জর্জ ব্রাউন ছাত্র আর মেলভিন ম্যাকনেয়ার একজন ব্যবসায়ী। সঙ্গে ছিলেন জিন ম্যাকনেয়ার আর জর্জ ব্রাউনের প্রেমিকা জয়েস টিলারসন। জিন আর মেলভিনের ততদিনে দুটি সন্তান জন্মেছে। জর্জ আর জয়েসেরও একটি সন্তান হয়েছে।

কোনভাবে তারা বিমানের ভেতর গোপনে তিনটি ছোট বন্দুক নিয়ে উঠতে সক্ষম হন। কেউ কেউ বলে বাইবেল ধর্মগ্রন্থের ভেতরে কেটে সেখানে বন্দুক বসিয়ে নেয়া হয়েছিল। আর বিমানবন্দরে যখন মেটাল ডিটেক্টর শব্দ করে উঠেছিল, নিরাপত্তা কর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন এই শব্দের কারণ মহিলাদের গায়ের গহনা।

মি. ম্যাকনেয়ারের সাথে কথা বলার সময় এখনও তিনি বিষয়টা ভাঙতে চাইলেন না। হয়ত বা বিমানবন্দরের কোন কর্মী এতে জড়িত ছিল, যে তাদের সাহায্য করে থাকবে!

ডেল্টা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮৪১ যখন ডেট্রয়েট থেকে মিয়ামির পথে, তখন ছিনতাইকারীরা কাজে নামার জন্য তৈরি হলেন। তবে তারা ঠিক করলেন যাত্রীদের খাওয়া শেষ করতে দেবেন।

এরপর তারা জানালেন তাদের দাবিদাওয়া- এক মিলিয়ন ডলার এবং আলজিয়ার্সে বিমানে করে পৌঁছে দিতে হবে। তারা কিন্তু যাত্রীদের ভয় দেখাননি।

“আমরা কোন আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইনি। আমাদের তিনটে বাচ্চাও তো আমাদের সাথে ছিল,” বলছিলেন মি. ম্যাকনেয়ার। “আমরা বরং একটা হালকা মেজাজ তৈরির চেষ্টায় ক্যাসেটে সোল মিউজিক বাজাচ্ছিলাম।”

বিমান মিয়ামিতে নামার পর এফবিআইয়ের সাথে ছিনতাইকারীদের দেনদরবার শুরু হল। প্রথমে পুলিশ তাদের জানাল তারা মাত্র ৫ লাখ ডলার দেবে। ছিনতাইকারীরা বলল, অর্ধেক অর্থ দিলে অর্ধেক পণবন্দীকে নিয়ে বিমান আবার আকাশে উড়বে।

পাদ্রী বেশী ছিনতাইকারী জর্জ রাইট মধ্যস্থতাকারীকে বললেন তিনি একজন পণবন্দীকে গুলি করার জন্য তৈরি। এফবিআই বেগতিক দেখে ১০ লাখ ডলার পণের অর্থ দিতে রাজি হল। মেলভিন ম্যাকনেয়ার বলেন তিনিই ঝুঁকি নিয়ে বিমানের দরজার মুখে আসেন এবং পণের অর্থ ভরা স্যুটকেসটা দড়ি দিয়ে টেনে বিমানে তোলেন।

বিমানটি তাদের নিয়ে যায় আলজিয়ার্সে। বিমানটি আলজিয়ার্স থেকে না ফেরা পর্যন্ত যাত্রীরা মাল নিতে না পারায় বিরক্তি প্রকাশ করেন কিছু কিছু যাত্রী। কিন্তু ছিনতাইকারীরা একটা গুলিও ছোঁড়েনি এবং কেউ শারীরিকভাবে বিন্দুমাত্র আহত হয়নি।

সবকিছু তাদের জন্য পরিকল্পনা মাফিক কাজ করেছিল। কিন্তু পরিকল্পনায় একটা ছোট ভুল থেকে গিয়েছিল। বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন উইলিয়াম মে জানালেন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে তিনি কখনও বিমান চালাননি। তার সাহায্য দরকার। তাই তাদের বিমান নিয়ে প্রথমে বস্টনে নামতে হল, সেখান থেকে একজন অভিজ্ঞ সহকারী প্লেনে উঠল। তাকেও সাঁতারের স্বল্পবাস পরে আসতে হল ছিনতাইকারীদের নির্দেশে।

নির্বিঘ্নে বিমান গিয়ে পৌঁছল আলজিয়ার্সে। লম্বা রাতের ফ্লাইট ছিল। পুরুষ ও নারী ছিনতাইকারীরা পালা করে ঘুমাল যাতে বিমানের ক্রুদের চোখে চোখে রাখা যায়।

বিমান আলজির্য়াসে পৌঁছনর পর সেনারা বিমান ঘিরে ফেলল। একজন কর্মকর্তা বিমানের ভেতর এসে আমাদের বললেন: “নিজের দেশে স্বাগতম।” মেলভিন ম্যাকনেয়ার বলছেন পাইলট কিন্তু ছিলেন সত্যিকার ‘হিরো’।

“আলজিয়ার্সে পৌঁছনর পর আমরা তাকে তার বাড়তি যাত্রার জন্য পারিশ্রমিক দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, ‘না, ধন্যবাদ’। তিনি এফবিআইয়ের কর্মকর্তাদের বুঝিয়েছিলেন আমরা মানুষ মারতে চাইনি। তিনি তাদের বলেছিলেন, বিমানের ভেতর পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ছিল।”

সবকিছু নির্বিঘ্নে হলেও পরে তাদের মনে হয়েছে অনেককিছুই গোলমাল হতে পারত।

তবে আলজিয়ার্সে পৌঁছনর কয়েকদিনের মধ্যে তাদের মনে হল তারা কৌশলগতভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্ল্যাক প্যান্থারের অল্প যে কয়েকজন সদস্য সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিল, তারা তখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ চলেও গেছে। আলজেরিয়া সরকারের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তখন উষ্ণ হতে শুরু করেছে।

এর জেরে ছিনতাইকারীদের বলা হল ওই ১০ লাখ ডলার ফিরিয়ে দিতে হবে। পণের অর্থ আমেরিকায় ফেরত পাঠানো হল। ব্ল্যাক প্যান্থার দলের হাতে গোণা যে কয়জন তখনও সেখানে ছিল, তারা খুবই চটে গেলেন। আমাদের নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। তারা চেয়েছিলেন ওই এক মিলিয়ন ডলার।

পরের চোদ্দ মাস, তারা সারাক্ষণ ভয়ের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। আলজিয়ার্সের উপকণ্ঠে যেখানে তারা থাকতেন, সেখানে খুবই অদ্ভুত ধরনের মানুষ ঘোরাফেরা করত, বলেন মি. ম্যাকনেয়ার। এদের কেউ আলজেরীয়, কেউ বিদেশি। মেলভিনের ধারণা তারা ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর গোয়েন্দা।

মেলভিন আর জিন সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের দুই বাচ্চাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেবেন আত্মীয়দের কাছে।

“এভাবে চোরের মত জীবন কাটানোয় কোন আনন্দ ছিল না। সর্বক্ষণ একটা বিপদের ঝুঁকি, যে ঘরে আসছে সে কে আপনি জানেন না, ঘুমনোর সময় এক চোখ খোলা রেখে ঘুমাতাম। সবসময় ভয় আর চাপা উত্তেজনা,” বলেন মেলভিন।

“আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, আলজেরিয়ায়ে প্যান্থারদের দিন শেষ।”

আবার তাদের পালানোর পালা। এবার গন্তব্য প্যারিস। ম্যাকনেয়ার দম্পতি আর জর্জ ব্রাউন ও জয়েস টিলারসন ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীর সহায়তায় জেনিভার মধ্যে দিয়ে প্যারিসে পৌঁছলেন ১৯৭৪ সালের শরৎকালে।

প্রথমে ফরাসী সহানুভূতিশীল কিছু মানুষ তাদের থাকার জায়গা দিল এবং খুচরো কাজ দিয়ে তাদের বাঁচার পথ করে দিল। মানুষকে তারা বলেছিল আমেরিকা তাদের ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে পাঠাচ্ছিল, তাই তারা আমেরিকা থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের ওই কাহিনি কাজ করেছিল।

মেলভিন আর জিনের জন্য সবচেয়ে কষ্টের ছিল তাদের বাচ্চাদের সাথে বিচ্ছেদ। শেষ পর্যন্ত ফরাসী পুলিশের হাতে তারা গ্রেপ্তার হন ১৯৭৬ সালে। আমেরিকা ফ্রান্সকে বলে তাদের বিচারের জন্য আমেরিকায় প্রত্যপর্ণ করতে। কিন্তু ফ্রান্সের আদালত অভিযু্ক্তদের যুক্তি মেনে নিয়ে বলে যে তাদের ফেরত চাওয়ার কারণ রাজনৈতিক। ফ্রান্স আমেরিকাকে বলে আমেরিকানদের বর্ণবাদের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় তোলা উচিত। কিন্তু বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগে ফরাসী আদালতে তাদের বিচার হয়।

মামলা চলাকালীন আড়াইবছর তাদের জেলে আটক থাকতে হয়। বিচারে দুই নারীকে মুক্তি দেয়া হয় তাদের সন্তানদের মানুষ করার জন্য। ম্যাকনেয়ারের পাঁচ বছর জেল হয়, তবে ভাল আচরণের কারণে এবং তিনি ফরাসী ভাষা শিখতে রাজি হওয়ায় তাকে পুরো সাজা খাটতে হয়নি। জর্জ ব্রাউনকে জেলে কাটাতে হয় আরও দীর্ঘ সময়। মেলভিনের ধারণা সে ফরাসী ভাষা শিখতে রাজি হয়নি।

ম্যাকনেয়ার অবশেষে মুক্তি পান ১৯৮০ সালের মে মাসে। এবং আট বছর পর পরিবারের সাথে মিলিত হন।

মেলভিন প্রশিক্ষণ নিয়ে সমাজকর্মী হিসাবে, পাশাপাশি ক্রীড়া প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন ফ্রান্সে। তিনি ও তার স্ত্রী জিন ৮০র দশকের গোড়ায় ফ্রান্সের নর্মান্ডিতে উপকূলীয় শহর খঁন-এ বসবাস শুরু করেন।

মেলভিন শহরের উপকেণ্ঠে এক দরিদ্র পল্লীর কয়েকশ শিশুকে বেসবল খেলার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। স্থানীয় বেসবল ক্লাবের খেলার মাঠের নামকরণ হয়েছে তার নামে।

জিনও সমাজসেবার কাজে যুক্ত হন। এলাকার বহু শিশুকে তিনি তাদের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন এবং মাথা তুলে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথা বলেছেন।

কয়েক বছর আগে জিন মারা যান। মেলভিনের বয়স এখন ৭২। এখনও তিনি পুরোদমে সমাজকর্মী। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে দুজন ফরাসী, বড় ছেলে আমেরিকায় ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু নর্থ ক্যারোলাইনায় পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।

মেলভিন আর জিনের কাহিনি নিয়ে ২০১২ সালে একটি তথ্য চিত্র তৈরি হয়। সেখানে কাঁদতে কাঁদতে মেলভিন ম্যাকনেয়ার বলেছিলেন, “আমার ছেলে ভুল সময়, ভুল জায়গায় ছিল। তাই গুলি খেয়ে মরতে হল। জীবনে আমি যা করেছিলাম, তা সন্তানদের বিদ্বেষমুক্ত পরিবেশে বড় করার আশাতেই করেছিলাম, তারপরও তাকে হারালাম।”

জয়েস টিলারসন প্যারিসে দক্ষিণ আফ্রিকা দূতাবাসে কাজ করতেন। ক্যান্সারে তিনি মারা যান ২০০০ সালে। জর্জ ব্রাউনও প্যারিসে মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে।

পঞ্চম ছিনতাইকারী জর্জ রাইট কেমন করে পশ্চিম আফ্রিকার গিনি বিসাউতে পৌঁছে যান, সেখান থেকে পর্তুগাল। এখনও পর্তুগালের বসিন্দা। আমেরিকার প্রত্যপর্ণের দাবি এড়িয়ে সেখানেই থেকে গেছেন।

ছিনতাই হওয়া বিমানের পাইলট উইলিয়াম মে, ম্যাকনেয়ারদের নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির সুবাদে ফ্রান্সে গেলে ম্যাকনেয়ারদের সাথে তার আবার দেখা হয়। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। মি. মে বলেছিলেন ”আমার কোন ক্ষোভ বা বৈরিতা নেই”।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..

পুরাতন সংবাদ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১