দেশে একমাত্র ব্যক্তি যিনি দুই দফায় প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য সংবিধান সংশোধনও করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। সাধারণ মানুষের কাছেও গণতন্ত্রের আইকন ছিলেন সাবেক বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এর আগমন ঘটেছিল ধূমকেতুর মতো। দেশে যখন রাজনৈতিক সংকট চলছিল, তখন ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব হন তিনি।
১৯৯০-এর গণআন্দোলন চলাকালে ওই বছর ২৭ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এতে সাধারণ মানুষ ফুঁসে ওঠে। শেষ পর্যন্ত একই বছর ৪ ডিসেম্বর এরশাদের নি:শর্ত পদত্যাগ করেন। এই ক্রান্তিলগ্নে কে চালাবেন দেশ? আলোচনায় বসেন তিন জোটের নেতারা। নির্দলীয় সরকারের প্রধান কে হবেন খুঁজতে থাকেন রাজনৈতিক নেতারা। অনেক আলোচনার পর তিন জোটের নেতারা ঐকমত্যে পৌঁছান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রস্তাব চোখ বন্ধ করে লুফে নিতে দেখা যায়নি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। তিনি একটি শর্তে রাজি হলেন, নির্বাচনের পর তাঁকে প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন প্রধানমন্ত্রী। তখনো সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তাঁর সভাপতিত্ব করার কথা; কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির হাতে যে ক্ষমতাই থাকুক না কেন, তিনি বললেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই দেশ চালাবেন। সাহাবুদ্দীন আহমদ দ্রুত নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেরও তাগিদ দিলেন। তখনো বিএনপির নীতিগত অবস্থান ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির সরকারের পক্ষে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী দলগুলো সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ে নিয়োগসহ নানান বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মতভেদ দেখা দেয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করতে থাকেন।
অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর বিএনপি সংসদীয় পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠায় রাজি হয়। পরবর্তিতে ৬ আগস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় ব্যবস্থা চালু হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে আগের দায়িত্বে ফিরে যান।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। এবার আওয়ামী লীগ নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সে ক্ষেত্রে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনই তাদের এক নম্বর পছন্দ। শেষ পর্যন্ত সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা রকম কথা বলে আওয়ামী লীগের বিরাগভাজন হন তিনি। আস্থা অনাস্থার মধ্যে ভালোই চলছিল তার রাষ্ট্রপতিত্বের মেয়াদকাল।
ঝামেলা বাঁধে ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দলের নেতারা এর দায় চাপালেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ওপর। তখন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে দেখা করে নির্বাচন বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাদের সেই দাবি মেনে নিতে পারেননি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের পছন্দের তালিকা থেকে অপছন্দের তালিকায় চলে যান সাহাবুদ্দীন আহমদ।
তিনি চেয়েছিলেন দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠুক, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটা কর্মসম্পর্ক থাকুক। সেই নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হয়, তখনই আওয়ামী লীগ নেতারা প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনকেও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেন।
এরপর থেকে একপ্রকার আড়ালেই থেকেছেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ২০০৫ সালের ২৩ জুন নিউইয়র্কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারপারসন অধ্যাপক সিতারা পারভীন। মেয়ের মৃত্যুতে পুরোপুরি ভেঙে পড়েন তিনি। তাকে আর প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানেও দেখা যায়নি নির্দলীয় সরকারের কাণ্ডারিকে। অবশেষে গণতন্ত্রের এই অতন্দ্র প্রহরী চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন। শনিবার (১৯ মার্চ) ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিসিএইউতে) চিকিৎসাধিন অবস্থায় সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেলক হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা দু:খ প্রকাশ করছি, দোয়া করি তার জন্য। মৃত ব্যক্তি সমন্ধে আমি কিছু বলতে চাই না। ইতিহাস তাকে মূল্যায়ন করবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি’।