প্রতিভা কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না কারো না কারো হাত ধরে প্রকাশিত হয় ।সতের বছর ধরে যে শিল্পী জানতেনই না তিনি একজন ভাস্কর, কুমিল্লার যে শিল্পী চকের ভাস্কর্যে আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরতে চান ।
চক। কেউ বলেন খড়িমাটি। ব্ল্যাক বোর্ডে লেখার কাজে ব্যবহার করা হয়। শিক্ষকরা স্কুলে চক ব্যবহার করেন।
ধরার অসুবিধার জন্য একটু বাকি থাকতে সেটি ফেলে দেয়া হয় প্রায় সময়। সেই ফেলে দেওয়া চক দিয়ে ক্ষুদ্র ভাস্কর্য গড়েছেন কুমিল্লার এক তরুণ। নাম তাঁর সামিউল আলম জাহেদ। বাড়ি কুমিল্লা শহরতলীর চাঁনপুরে । তিনি অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। কিন্তু আর্টের শিক্ষক ও তিনি একজন ভাস্কর। ওনার “রেইনবো আর্ট স্কুল” নামে স্কুল আছে। সেখানে বাচ্চাদের আর্ট শেখান ।
বাবা ব্যবসায়ী শহীদুল আলম। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ৩য়। সেই ভাস্কর্য দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কারও।
জাহেদ জানান, ফেলে দেওয়া চকে তিনি সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যানদের ফুটিয়ে তুলতেন।
এরপর নতুন চকে শুরু করেন। বন্ধুদের অনেকে আড়ালে মুখ টিপে অবজ্ঞার হাসি হেসেছেন। চকে আবার ভাস্কর্য! সাথে তিনি রঙ দিয়ে ছবি আঁকেন। গিটারে সুর তোলেন। তবে পরেরগুলো নিয়ে নিকটজনরা বাহবা দিতেন।কিন্তু তার মন পড়ে থাকে চকে। টেবিলের ড্রয়ারে রাখা চকের ভাস্কর্যগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। কিছু পোকা খাদ্য বানিয়েছে। কিছু ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু তার মন ভাঙতে পারে না। ভাবতে থাকেন কিভাবে তার কাজগুলোকে মজবুত করা যায়। চকে ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলার পর তিনি সেগুলো গামে ডুবিয়ে নেন। শুকানোর পর সেগুলো শক্ত হয়ে যায়।
২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল। নিজের বানানো ভাস্কর্যগুলো ড্রয়ারে ফেলে রেখেছিলেন জাহেদ। চারুকলার শিক্ষার্থী বন্ধু শাকের এসব ভাস্কর্য দেখে তাকে জানান এসব মিনিয়েচার ভাস্কর্য। এগুলো নিয়ে প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া সম্ভব। ১৭ বছর পর জাহেদ বুঝতে পারেন তিনি যা তৈরি করেছেন সেগুলো একটি শিল্প। ৭২টি মিনিয়েচার ভাস্কর্য নিয়ে অংশ নেন জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীতে, জিতে নেন পুরস্কার।
তিনি ২০০২ সালে কুমিল্লা হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০০৪ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, ২০০৮ সালে একই কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ২০০৯ সালে স্নাতকোত্তর করেন। ২০১৭ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে বিএফএ ডিগ্রি এবং ২০১৯ সালে এমএফএ (প্রিন্টিং এন্ড ড্রয়িং) পাস করেন। বর্তমানে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে।
জাহেদ বলেন, তিনি এই শিল্প নিয়ে যেতে চান বহুদূর। চকের গায়ে ফুটিয়ে তুলছেন বাঙালির আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস।
তার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ২য় তলায় তার চকের যত কারবার। প্রথমে কম্পাসের কাঁটা আর সুঁই দিয়ে কাজ করলেও এখন বিশেষ ধরনের কাঁটা সংগ্রহ করেছেন। চকের মণ্ড বানিয়ে বিভিন্ন চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তোলেন। চকের মাথায় শেরে বাংলা, বঙ্গবন্ধু, মাদার তেরেসা, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক মনীষীর দেখা মেলে।
বাবা ব্যবসায়ী শহীদুল আলম বলেন, ছোট থাকতে জাহেদের আঁকাআঁকির শখ। চক দিয়ে ভাস্কর্য ব্যতিক্রম বলে জানতে পেরেছি। তার কাজ আলোচনায় আসার পর বাসায় এখন প্রায় মানুষ আসেন। তারা তার কাজ দেখতে চান। ছেলের সাফল্য দেখে ভালো লাগছে।
কুমিল্লা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, কুমিল্লা হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকে সে চকে ভাস্কর্য তৈরি করছে। জাহেদ আমাদের ছাত্র। এখানে সে কয়েক বছর শিক্ষকতাও করেছে। তার সাফল্যে আমরা আনন্দিত। তার খ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়ুক।
কুমিল্লা আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল সুলতান শাহরিয়ার বলেন, জাহেদ সৃজনশীল ছেলে। তার কাজে আমরা মুগ্ধ। সে আগামীতে আরও ভালো করবে বলে আমরা আশা করি।
কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ নার্গিস আক্তার বলেন, জাহেদ আমাদের প্রতিষ্ঠানের চারুকলার শিক্ষক। তিনি আন্তরিকভাবে চারুকলার পাঠ দিচ্ছেন। তার সংস্পর্শে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা বিকাশ করতে পারবে।